পাহাড়পুর (প্রত্নতাত্ত্বিক) নওগাঁ জেলা এবং বদলগাছী থানার অধীনস্থ পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। পাকা সড়কের মাধ্যমে গ্রামটির নিকটস্থ রেলস্টেশন জামালগঞ্জ এবং নওগাঁ জয়পুরহাট জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। এ প্রত্নস্থল উত্তরবঙ্গের প্লাবনভূমিতে অবস্থিত। বিস্তীর্ণ একটানা সমভূমির মাঝে এক সুউচ্চ (পার্শ্ববর্তী ভূমি থেকে প্রায় ২৪ মিটার উঁচু) প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ স্বভাবতই একে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। স্থানীয়ভাবে পাহাড় নামে পরিচিত এ ধ্বংসাবশেষের অবস্থান থেকে পাহাড়পুর নামের উৎপত্তি হয়েছে।
পূর্বভারতে জরিপ কাজ পরিচালনাকালে ১৮০৭ ও ১৮১২ সালে বুকানন হ্যামিল্টন সর্ব প্রথম প্রত্নস্থলটি পরিদর্শন করেন। পরবর্তীকালে ওয়েস্টম্যাকট পাহাড়পুর পরিভ্রমণে আসেন। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ সালে এ স্থান পরিদর্শন করেন ও এই ঢিবিতে ব্যাপক খনন করতে চান। কিন্তু বলিহারের জমিদার কর্তৃক তিনি বাধাপ্রাপ্ত হন। ফলে বিহার এলাকার সামান্য অংশে এবং কেন্দ্রীয় ঢিবির শীর্ষভাগে সীমিত আকারে খননের কাজ চালিয়েই তাঁকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। শেষোক্ত এলাকায় তিনি চারপাশে উদ্গত অংশযুক্ত ২২ ফুট বর্গাকার একটি ইমারত আবিষ্কার করেন। প্রত্নস্থলটি ১৯০৪ সালের পুরাকীর্তি আইনের আওতায় ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ কর্তৃক ১৯১৯ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয়।
ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ, বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটিএবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক যৌথভাবে ১৯২৩ সালে সর্বপ্রথম এখানে ব্যাপক আকারে খনন শুরু হয়। এ যৌথ কার্যক্রম প্রথমে দিঘাপতিয়ার জমিদার বংশের কুমার শরৎ কুমার রায়-এর অর্থানুকূল্যে এবং ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের পশ্চিম অঞ্চলের প্রাক্তন সুপারিনটেনডেন্ট প্রফেসর ডি.আর ভান্ডারকরের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এ সময়ে খনন কাজ বিহারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের কয়েকটি ভিক্ষু কক্ষে এবং পার্শ্ববর্তী প্রাঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকে। পরে ১৯২৫-২৬ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কেন্দ্রীয় ঢিবির উত্তরাংশে খনন করেন। পরবর্তী মৌসুম (১৯২৬-২৭) থেকে ১৯৩৩-৩৪ সাল পর্যন্ত কে.এন দীক্ষিত-এর নেতৃত্বে পাহাড়পুরে খনন কাজ অব্যাহত থাকে। তবে মধ্যবর্তী দুই মৌসুমে (১৯৩০-৩২) জি.সি চন্দ্র খনন পরিচালনা করেন। সর্বশেষ মৌসুম দুটিতে (১৯৩২-৩৪) কেন্দ্রীয় মন্দির থেকে ৩৬৪ মিটার পূর্বে সত্যপীর ভিটায় খনন করা হয়
স্বাধীনতাত্তোরকালে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ পাহাড়পুরে পুনরায় খনন কাজ পরিচালনা করে। কয়েক পর্বের এ খননের ১ম পর্ব ১৯৮১-৮২ মৌসুমে শুরু হয় এবং ১৯৮৪-৮৫ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। বিরতিসহ দ্বিতীয় পর্বের খনন কাজ ১৯৮৮-৮৯ থেকে ১৯৯০-৯১ পর্যন্ত চালু থাকে। প্রথম পর্যায়ের খননের উদ্দেশ্য ছিল দীক্ষিতের প্রতিবেদনে বর্ণিত বিহারের ভিক্ষু কক্ষে তিনটি নির্মাণ যুগের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং প্রত্নস্থলের পূর্বের স্তরসমূহ আবিষ্কার করা।
স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ স্বাধীনতা-পূর্ব যুগের খননের ফলে সোমপুর মহাবিহার নামে উত্তর-দক্ষিণে ২৭৪.১৫ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে ২৭৩.৭০ মিটার পরিমাপ বিশিষ্ট বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রকান্ড এই স্থাপনার চতুর্দিকের ১৭৭টি বসবাস উপযোগী কক্ষ, বিস্তৃত প্রবেশপথ, অসংখ্য নিবেদন-স্তূপ, ছোট ছোট মন্দির, পুকুর ও সংলগ্ন অন্যান্য নিদর্শন ছাড়িয়ে রয়েছে, মাঝে স্থাপত্য-বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুউচ্চ একটি মন্দির। ধাপবিশিষ্ট এ মন্দির ক্রুশাকৃতি ভূমিপরিকল্পনায় নির্মিত। ক্রুশের প্রতি দুই বাহুর মধ্যবর্তী স্থানে উদ্গত অংশ কৌণিকভাবে বিন্যস্ত। মন্দিরের দেয়ালে গাত্রের কুলুঙ্গিতে পোড়ামাটির ফলক এবং প্রস্তর ভাস্কর্য দ্বারা সুশোভিত।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস