মহাস্থান, প্রাকৃতিক কাঠামো করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত বাংলাদেশের এই প্রাচীনতম পুরাকীর্তিটি বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১২ কিমি উত্তরে অবস্থিত। পাকা সড়ক দ্বারা স্থানটি শহরের সঙ্গে যুক্ত। ভৌগোলিকভাবে মহাস্থান গড় ২৪°৫০´ উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২৫°০´ উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত এবং ৮৯°১৫´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ৮৯°৩০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এটি বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা ও বগুড়া সদর উপজেলা জুড়ে অবস্থিত। চতুষ্পার্শেতর কৃষিজমির চেয়ে গড়ে প্রায় ৫ মিটার উচ্চে অবস্থিত এই দৃষ্টিনন্দন পুরাকীর্তির স্থানটি একটি আয়তাকার ঢিবি, যার দৈর্ঘ্য ১৫২৪ মিটার এবং প্রস্থ ১৩৭০ মিটার।
জলবায়ু প্রধানত ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। মে মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। তাপমাত্রা, বায়ুচাপ এবং বৃষ্টিপাতের বৈচিত্র্য বিবেচনা করে মহাস্থান গড়ের জলবায়ুকে পরিমিত বৃষ্টিপাত বিশিষ্ট উষ্ণ গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ু উপ-বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বার্ষিক বৃষ্টিপাত পূর্ব থেকে পশ্চিমে হ্রাস পায়। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পরিসর ৩৭°সে থেকে ৩৯°সে পর্যন্ত এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পরিসর ৭°সে থেকে ১০°সে-এর মধ্যে।
মৃত্তিকা প্রায় ৬০ ভাগ এলাকার মৃত্তিকা বরেন্দ্র ও লালমাই সোপান গঠনকারী অর্ধ-সংহত (semi-consolidated) প্রবীণতর মধুপুর কর্দম দ্বারা গঠিত। বাকি এলাকা বাঙ্গালী ও করতোয়া নদীসঞ্চিত নবীন ও প্রায়-নবীন অসংহত পলল দ্বারা গঠিত।
কৃষি মহাস্থান গড়ের অধিকাংশ এলাকাই চাষের অধীন, তবে কিছু কিছু স্থানে প্রাকৃতিক উদ্ভিজ্জ বিদ্যমান রয়েছে। বরেন্দ্রভূমির উচ্চতর স্থানসমূহ মিশ্র বনভূমি, গুল্ম এবং পুনর্বনায়নকৃত গজারী ও শাল গাছ দ্বারা আবৃত। প্লাবনভূমির মৃত্তিকা সম্ভবত তৃণভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। গড়ের প্রায় সর্বত্রই শস্য জন্মানো হয়ে থাকে এবং চাষাবাদ পদ্ধতি বর্তমান উদ্ভিজ্জকে ব্যপকভাবে প্রভাবিত করেছে। মোট কৃষিভূমির প্রায় ১০ শতাংশ এলাকা তিন ফসলী, ৩৮ শতাংশ এলাকা দুই ফসলী এবং ৪০ শতাংশ এলাকা এক ফসলী। তৃণভূমি এবং পতিতভূমির মিলিত পরিমাণ মোট ভূমির প্রায় ২ শতাংশ, যেখানে বসতি, জলাশয় এবং নদনদীর আওতাভুক্ত ভূমির পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ। মহাস্থান গড়ের বর্তমান ভূমি ব্যবহার প্রধানত বার্ষিক প্লাবনের সাপেক্ষে ভূমির উত্থান এবং শুষ্ক মৌসুমে জমির আর্দ্রতার প্রাপ্তি দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে। প্রধান কৃষিদ্রব্য ধান এবং বেশিরভাগ এলাকায় আউশ ও রোপা আমন ধান চাষ করা হয়। তুলনামূলকভাবে উঁচুজমিতে এবং বাড়িঘরের কোলাজমিতে শাকসবজি, কলা, বিভিন্ন প্রকার ফলজ বৃক্ষ, পান প্রভৃতি চাষ করা হয়।
ভূপ্রকৃতি ও ভূসংস্থান পললভূমির মধ্যে কিছুটা উত্থিত সোপান ভূমিরূপবিশিষ্ট মহাস্থান গড় বরেন্দ্রভূমির লোহিত স্তরের উপর অবস্থিত। তুলনামূলকভাবে প্লাবনমুক্ত ভূপ্রাকৃতিক এই এককের উচ্চতা ১৫ মিটার থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত। উপত্যকাসমূহের মধ্যে অবস্থিত শৈলশিরাসমূহের চূড়া মোটামুটি সমতল। উপত্যকা ও শৈলশিরাসমূহের পাদদেশ ঘনবিন্যস্ত সোপান চাষাবাদের আওতাভুক্ত।
নিষ্কাশন ব্যবস্থা অসংখ্য ক্ষুদ্র ও পরিখা আকৃতির অাঁকাবাঁকা স্রোতধারা ও নদনদী দ্বারা মহাস্থান গড় উত্তমরূপে নিষ্কাশিত। বরেন্দ্রভূমির পশ্চিম এলাকা মহানন্দা ও পুনর্ভবা নদী এবং তাদের অসংখ্য উপনদী দ্বারা নিষ্কাশিত, যারা দক্ষিণাভিমুখে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা নদীতে পতিত হয়েছে। বরেন্দ্রভূমির মধ্যভাগ ও পশ্চিমভাগ দুটি প্রধান নদী আত্রাই ও করতোয়া দ্বারা নিষ্কাশিত, যারা দক্ষিণপূর্বে শক্তিশালী যমুনা নদীতে পতিত হয়েছে। পুনর্ভবা, আত্রাই এবং পুরাতন যমুনা নদীত্রয় প্লাইসটোসিন বরেন্দ্রভূমিকে কর্তিত করে প্রবাহিত হয়েছে। বরেন্দ্র এলাকার বেশিরভাগ ক্ষুদ্র প্রবাহ ঋতুভিত্তিক এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাত থেকে জলপ্রবাহ লাভ করে। প্রধান নদীসমূহ সারা বৎসরই প্রবাহিত হয়, তবে শুষ্ক মৌসুমে অগভীর ও শীর্ণকায় ধারা হিসেবে প্রবাহিত হয়, আবার বর্ষাকালে অতি প্রবাহ প্লাবনের সৃষ্টি করে।
প্রধান নদী করতোয়া মহাস্থান গড়ের পূর্ব প্রান্ত দিয়ে দক্ষিণমুখে প্রবাহিত হয়েছে। ইছামতি, বাঙ্গালী এবং নাগর মহাস্থান গড়ের চারপাশ ঘিরে রয়েছে। পূর্ব পার্শ্ব দিয়ে দক্ষিণপূর্বাভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে বাঙ্গালী ও ইছামতি। পশ্চিম পার্শ্ব দিয়ে দক্ষিণপশ্চিমাভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে নাগর নদী। স্থানীয়ভাবে বিল নামে পরিচিত অনেক জলাশয় এই এলাকায় দেখতে পাওয়া যায়।
ভূমিরূপ এককসমূহ বগুড়া জেলার মহাস্থান গড়কে দুটি প্রধান ভূমিরূপে বিভক্ত করা যায়: (১) বরেন্দ্র সোপান এবং (২) করতোয়া-বাঙ্গালী সর্পিলাকার প্লাবনভূমি।
বরেন্দ্র সোপান করতোয়া নদীর পশ্চিমে অবস্থিত। প্লাইসটোসিন সময়কালের এই ভূমিরূপ একক মধুপুর কর্দম দ্বারা গঠিত ধারাবাহিক কতগুলো উত্থিত সোপানকে নির্দেশ করে। বরেন্দ্রভূমির বৃহত্তর অংশ অকর্তিত এবং দুর্বলরূপে নিষ্কাশিত ধূসর মৃত্তিকা দ্বারা গঠিত, যার উপরে অল্প গভীরতায় রয়েছে কর্দমশিলা। প্রায় সমতল এই ভূমির উপর দিয়ে অল্প কয়েকটি ক্ষুদ্র নদী প্রবাহিত হয়েছে। বরেন্দ্রভূমির দুটি উপ-বিভাগ হচ্ছে: (ক) প্রায় সমতল বরেন্দ্রভূমি এবং (খ) প্রশস্ত কর্তিত বরেন্দ্রভূমি।
বগুড়া জেলার পশ্চিমাংশ জুড়ে প্রায় সমতল বরেন্দ্রভূমি অবস্থিত। এই ভূমিরূপটি নিম্ন উচ্চতাবিশিষ্ট সমতলপ্রায় উত্থিত সোপান নিয়ে গঠিত, যার চারিদিক চ্যুতিবেষ্টিত। করতোয়া এবং ছোট যমুনা নদীদ্বয় এসকল চ্যুতির পাদদেশ দিয়ে প্রবাহিত। এখানকার মৃত্তিকা ধূসর, স্থানে স্থানে কর্বুরিত এবং নিম্ন প্রবেশ্যতাবিশিষ্ট।
প্রশস্ত কর্তিত বরেন্দ্রভূমি অবশিষ্ট সোপান এলাকার তুলনায় উচ্চতর এবং অধিকাংশই বরেন্দ্রভূমির পূর্ব ও উত্তরপূর্ব অংশে অবস্থিত। উত্থিত এবং আনত এই এলাকাসমূহ প্রশস্তভাবে উপত্যকাসমূহ দ্বারা কর্তিত, যাদের অধিকাংশই প্রবাহহীন। এই এলাকা তুলনামূলকভাবে অত্যধিক বিচূর্ণিত (weathered) উত্তম থেকে পরিমিত উত্তম নিষ্কাশিত লোহিত অথবা বাদামি মৃত্তিকা দ্বারা গঠিত।
করতোয়া-বাঙ্গালী সর্পিলাকার প্লাবনভূমি বিভিন্ন সময়কাল ও উৎসের পলল দ্বারা গঠিত একটি জটিল ভূমিরূপ। একটি অধিকতর পুরানো ভূমিরূপের উপর এই দুটি নদীর পলল আংশিকভাবে সঞ্চিত হয়েছে বলে দৃশ্যমান হয়। এই ভূমিরূপ নিম্নতর তিস্তা প্লাবনভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। প্রশস্ত শৈলশিরা এবং অববাহিকাসমূহ দ্বারা এই প্লাবনভূমির অধিকতর অংশ গঠিত। শৈলশিরাসমূহে পলিকণার এবং অববাহিকাসমূহে কর্দমের প্রাধান্য রয়েছে। নদীখাত বরাবর এবং শৈলশিরার স্থানবিশেষে শুধুমাত্র বালুর উপস্থিতি রয়েছে।
ভূতত্ত্ব মহাস্থান গড় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি বাংলাদেশের সোপান এলাকায় (shelf area) অবস্থিত। ভূ-গাঠনিক (tectonically) দিক থেকে এই স্থান হিঞ্জ জোনের (Hinge zone) নিকটতম সক্রিয় বগুড়া ঢালের অন্তর্ভুক্ত। বিমান-চৌম্বক জরিপ থেকে দেখা যায়, এই অঞ্চলের ভিত্তিশিলা অসংখ্য চ্যুতি রেখা দ্বারা জালের ন্যায় কর্তিত। এ সকল চ্যুতির উল্লম্ব স্থানচ্যুতি উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-উত্তরপূর্ব থেকে দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিম দিকে বিন্যস্ত। শুধুমাত্র অল্প কয়েকটি চ্যুতি উদ্ভেদ গঠন করেছে যেমন, করতোয়া নদীর চ্যুতি। ভূ-কম্পন বলয় মানচিত্র অনুসারে মহাস্থান গড়ের অবস্থান ২ নং বলয়ে, অর্থাৎ এই অঞ্চল মাঝারি ধরনের ভূ-কম্পন প্রবণতাসম্পন্ন।
প্লাইসটোসিন মধুপুর কর্দম অপেক্ষা পুরাতন পলল মহাস্থান গড়ে পাওয়া যায়নি। যদিও বগুড়া ঢাল এলাকাসহ সুস্থিত সোপান অঞ্চলের ভূগর্ভে অবস্থিত প্রিক্যাম্ব্রিয়ান ভিত্তিশিলায় পার্মিয়ান (২ কোটি ৮৬ লক্ষ বছর থেকে ২ কোটি ৪৫ লক্ষ বছর পূর্বে) সময়কাল থেকে সাম্প্রতিক (১ লক্ষ বছরের পুরানো) কালের পাললিক শিলার উপস্থিতি রয়েছে। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS